শিক্ষকতা সম্পর্কে ড. রণজিৎ বসুর উক্তি
শিক্ষকতা সম্পর্কে ড. রণজিৎ বসুর উক্তি :
![]() |
শিক্ষকতা সম্পর্কে ডঃ রণজিৎ বসুর উক্তি |
“শিক্ষকতা আর পাঁচটা কর্পোরেট পেশার মত নয়। এটা বরং পারফর্মিং আর্ট।... বলে, লিখে শেখাতে হয়।...এই পেশার দাবি বডি ল্যাংগুয়েজ নয়, মাইন্ড ল্যাংগুয়েজ। মনের ভাষা”
— ডক্টর রণজিৎ বসু
উক্তিটি ইংরেজিতে পড়ুন
উক্তিটির উৎস এবং প্রসঙ্গ জানুন :
পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ডঃ রণজিৎ বসু। একজন আদর্শ শিক্ষক কেমন হবেন, এ বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি তাঁর লেখা ‘বডি ল্যাংগুয়েজ, অভিনয়ের মতো শিক্ষকতাও একটা পারফর্মিং আর্ট’ নামক নিবন্ধে এই কথাগুলি বলেছেন।
নিবন্ধটি প্রকাশিত হয় আজকাল প্রকাশনার মাসিক পত্রিকা ‘সোপান’-এর জানুয়ারি ২০০৭ সংখ্যায়। পৃষ্ঠা ১০-১১।
এখানে তিনি বলছেন, “শিক্ষকতা আর পাঁচটা কর্পোরেট পেশার মত নয়। এটা বরং পারফর্মিং আর্ট। বলে, লিখে শেখাতে হয়। এই পেশার দাবি বডি ল্যাংগুয়েজ নয়, মাইন্ড ল্যাংগুয়েজ। মনের ভাষা”
কিন্তু কীভাবে? বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য তিনি তুলে এনেছেন তাঁর ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা। তিনি লিখছেন, “আমার এক বন্ধু বাড়িতে পড়াশোনার কোনো বিষয় নিয়ে তাঁর ছেলেকে বকাবকি করছিলেন। তাঁর ছেলে জবাব দিয়েছিল, তুমি কি আমার স্যারের চেয়েও বেশি জানো? স্যার তো আমাকে বলেছেন এভাবে পড়তে...।” এরপর তিনি বলছেন, “ছাত্রদের কাছে শিক্ষকের স্থানটা এরকমই। তার বাবা মায়ের মত। কখনো কখনো তার চেয়েও উপরে। তাই শিক্ষকদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ-এর মধ্যে ছেলে মেয়েরা যেন নিজেদের বাবা-মায়ের ছায়া খুঁজে পায়। খুঁজে পায় আশ্রয়। এর জন্য যেটা প্রয়োজন (তা হল) কমিউনিকেশন স্কিল। কমিউনিকেশন মানে শুধু কথা বার্তায় চৌকস হওয়া নয়। সব রকম ভাবে। শুরুতেই ছাত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া।... নিজের ছেলে মেয়ের কাছে একজন মা বা বাবা হিসেবে তোমার যে ভাবমূর্তি কাম্য, ছাত্রছাত্রীদের কাছেও যেন সেই ভাবমূর্তি বজায় থাকে। আসলে শিক্ষকদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজটা কেবল শরীরের ভাষায় নয়, জড়িয়ে আছে মনের ভাষাতেও (মাইন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ)। মন দিয়ে, ভালোবেসে না পড়ালে, বিষয়টার প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ তৈরি হয় না। এর জন্য প্রথমেই দরকার ছাত্রদের ভাষায়, ছাত্রদের বোঝানো, ছাত্রদের মত হয়ে, বন্ধুর মত হয়ে।”
বিষয়টি প্রাঞ্জল করার জন্য তিনি উদাহরণের সাহায্য নিলেন।
লিখছেন, “ধরা যাক কেউ লেডি ব্রেবোর্নে পড়াশোনা করেছো। শিক্ষিকা হিসেবে চাকরি পেয়েছো দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসাবার কোন স্কুলে। তোমার ছাত্রীরা টিফিনে মুড়ি খায়, বাংলা বলে নিজেদের আঞ্চলিক উচ্চারণে। কী করবে? ওদের কি ‘দোখনো’ বলবে? কথায় কথায় বুঝিয়ে দেবে ওরা গ্রামে থাকে, অনেক পিছিয়ে আছে? বা ধর এমন একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছো যেখানে সব ছাত্ররাই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী।... সামান্য একটা অংক বোঝাতে গলদঘর্ম হয়ে যেতে হচ্ছে। বিরক্তির সঙ্গে একদিন বলেই ফেললে, তোদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না...। যে মুহূর্তে এ কথাটা বলবে, সেই মুহূর্তে শিক্ষক হিসেবে একটা বিগ জিরো।”
এই নিবন্ধে তিনি বলছেন, “কীভাবে তুমি জানাচ্ছ, কী জানাচ্ছ, কাদের জানাচ্ছ — প্রতিনিয়ত এই শর্তগুলো যেন পরিষ্কার থাকে। দরকার হলে অংক ক্লাসে গল্প বলতে হবে বৈকি! তবে সেটা যেন প্রাসঙ্গিক হয়। মানে, বাইরের জগত সম্পর্কেও বেশ ধ্যান-ধারণা থাকতে হবে, শুধু পড়ার বই কি যথেষ্ট? ক্রিকেটে ২২ গজের ভিতরের খেলাটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ২২ গজের বাইরের খেলাটাও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার মনে হয়, শিক্ষকতাটাও একটা পারফর্মিং আর্ট, অভিনয়ের মতো। পড়াবেন ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের দিকে তাকিয়ে, দরোজা বা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে নয়। স্কুল সার্ভিস কমিশনে ৮ থেকে ১০ মিনিটের যে পার্সোনালিটি টেস্ট নেওয়া হয়, সেখানে ভালো শিক্ষকের বদলে আমরা খুঁজি একজন কার্যকরী বা এফেক্টিভ শিক্ষককে। একজন এফেক্টিভ শিক্ষকের গুণ হল, প্রতিদিন বইয়ের পড়াটা পড়ে ক্লাসে যাওয়া, নিজের বিষয় সম্পর্কে আপটুডেট থাকা, পরিষ্কারভাবে কথা বলতে পারা, বন্ধু হয়ে ছাত্রদের আস্থা অর্জন করা।”
স্কুল সার্ভিস কমিশনের লেখা পরীক্ষায় পাশ করার পর নেওয়া হত ১০ নম্বরের পারসোনালিটি টেস্ট। এই টেস্টের মাধ্যমে একজন হবু শিক্ষকের কাছ থেকে কোন্ কোন্ বিশেষ গুণ বা সক্ষমতার উপস্থিতি যাচাই করা হয়?
তাঁর কথায়, “এটা ঠিক, পার্সোনালিটি টেস্টে মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে একজন হবু শিক্ষক ও শিক্ষিকার কতটাই বা আমরা জানতে পারি। কিন্তু আমাদের মনে হয়, কেউ শিক্ষক হয়ে জন্মান না। শিক্ষক আসলে হয়ে উঠতে হয়। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘টিচার্স আর দ্যা বেস্ট
লার্নারস’, এটাকেই আরও সহজে বলেছিলেন রামকৃষ্ণদেব : ‘যতদিন বাঁচি, ততদিন শিখি’। কাদের কাছ থেকে শিখব? আমার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকেই তো।
শিখতে শিখতে শেখানো —এটাই হওয়া উচিত একজন আদর্শ শিক্ষকের ভাষা। তুমি ভাবতে পারো, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ।
-----------xx-----------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন