নারীবিদ্বেষ সম্পর্কে শময়িতা চক্রবর্তী মন্তব্য
নারীবিদ্বেষ সম্পর্কে শময়িতা চক্রবর্তী মন্তব্য :
“পছন্দের মহিলার থেকে প্রেমের স্বীকৃতি না পেয়ে বিশাল সংখ্যক পুরুষ ভার্চুয়াল নারীবিদ্বেষী গোষ্ঠীতে নাম লেখাচ্ছে।”
— শময়িতা চক্রবর্তী
উক্তিটি ইংরেজিতে পড়ুন
উক্তিটির উৎস ও প্রসঙ্গ জানুন :
Shamayita Chakrabortys quote about MisogynyShamayita-Chakrabortys-quote-about-Misogyny
এই সময় (সংবাদপত্র) ১৩/০৪/২০২৫
জেমি মিলার। ১৩ বছরের এক কিশোর, যে তার স্কুলের এক ছাত্রীকে কুপিয়ে খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত। জেমি মিলার আসলে ব্রিটিশ ওয়েব সিরিজ ‘অ্যাডোলেসেন্স’ নামক একটি সাইকোলজিক্যাল ক্রাইম ড্রামা সিরিজের কিশোর চরিত্র।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কীভাবে নারী বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের অলিতে গলিতে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাংবাদিক শময়িতা চক্রবর্তী এই ওয়েব সিরিজের প্রসঙ্গ এনেছেন। এই সিরিজের তিন নম্বর এপিসোডের শেষ দিকে জেমি মিলার বলছে, “আমি চাইলেই ওকে (মৃত মেয়েটিকে) ছুঁতে পারতাম। ওর শরীরের যে কোনও অংশে হাত রাখতে পারতাম। অন্য যে কোনও ছেলে তা-ই করত। আমি ওর গায়ে হাত দিইনি। এতে কি আমি অন্যদের তুলনায় ভালো হই না?”
জেমি মিলার এর এই মন্তব্যকে সামনে রেখে শময়িতা চক্রবর্তী জেমি মিলার-এর এই প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছেন, হুমায়ূন আহমেদের একটি উক্তি উদ্ধৃতির মাধ্যমে। যেখানে হুমায়ুন আহমদ বলছেন, “না, কোন মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ না নিলে সমাজ তোমার পিঠ চাপড়াবে না। কারণ, দুর্বলতার সুযোগ না নেওয়াটাই দস্তুর।”
এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, এই ১৩ বছরের জেমি মিলারের মনে নারীর প্রতি যে ‘অতলান্তিক অসম্মানের’ আভাস তিনি পেয়েছেন, তা তাঁকে এই সিরিজের মনোবিদ (যার দায়িত্ব পড়েছে জিমির মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার) ব্রায়োনির মতোই স্তম্ভিত করে তুলেছে। তাই ব্রায়োনির মত তিনিও খোঁজার চেষ্টা করেছেন, এই নারী বিদ্বেষের নতুন কোন্ মানসিকতা এর পিছনে কাজ করছে, কোথা থেকেই বা তার উৎপত্তি!
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ার কথা। শময়িতা চক্রবর্তী লিখছেন, “সোশ্যাল মিডিয়া ছিলনা আর সোশ্যাল মিডিয়া আছে, এই দুটো পৃথিবীর মধ্যে জমিন আসমানের ফারাক।” এই ছয় মাস মাধ্যম নাগরিক সমাজের জীবনকে তছনছ করে দিচ্ছে বলে তার পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ছে। তাঁর পর্যবেক্ষণ বলছে, “জেমির মত অনেক ছেলেই মনে করে, সাধারণ নিয়মে মেয়েরা তাদের পাত্তা দেবে না। তারা নিজেদেরকে ইনসেল বা ‘ইনভলান্টারি সেলিবেটস’ কালচারের অংশ বলে মনে করে। এই পাত্তা না দেওয়ার জন্য তারা মেয়েদেরকেই দায়ী করে। তিনি লিখেছেন, “এর (এই পাত্তা না দেয়ার বিষয়টির) নানা প্রকার ভেদ আছে। কাউকে বোঝানো হয় ৮০ শতাংশ মহিলা শুধুমাত্র কুড়ি শতাংশ পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কেউ আবার ধরে নেয় মহিলাদের মন জয় করতে গেলে তাদের দারুন সফল (এবং মূলত বিত্তবান) হতে হবে। এর থেকে এদের মনে জন্ম নেয় এক বিশেষ ধরনের নারী-বিদ্বেষ।
সাংবাদিক সময় তা চক্রবর্তীর মতে, এই নারী বিদ্বেষের নতুন মাধ্যম হয়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া। তিনি যার নাম দিয়েছেন ‘ভার্চুয়াল নারীবিদ্বেষ’। আর যখন কোনও ব্যর্থ প্রেমিক পছন্দের মহিলার থেকে প্রেমের স্বীকৃতি পাচ্ছেন না, তখনই তিনি হয়ে উঠছেন ‘ভার্চুয়াল নারীবিদ্বেষী’। তাঁর কথায়, “পছন্দের মহিলার থেকে প্রেমের স্বীকৃতি না পেয়ে বিশাল সংখ্যক পুরুষ ভার্চুয়াল নারী-বিদ্বেষী গোষ্ঠীতে নাম লেখাচ্ছে।”
এই পর্যবেক্ষণের প্রমাণ হিসেবে তিনি ব্রিটিশ ব্যবসায়ী অ্যান্ড্রু টেট-এর মত সমাজে প্রভাবশালী পুরুষের মোটিভেশনাল বক্তৃতার প্রসঙ্গ এনেছেন। শময়িতা চক্রবর্তীর মতে, এই ধরনের মোটিভেশনাল বক্তৃতার মাধ্যমে টেট সোশ্যাল মিডিয়ায় মেনোস্ফিয়ার বা ‘পুরুষ অধিকার রক্ষার পরিমণ্ডল’ তৈরি করে চলেছেন।
কী আছে অ্যান্ড্রু টেট-র মোটিভেশনাল বক্তৃতায়? সাংবাদিক শময়িতা চক্রবর্তী বলেছেন, “তিনি মনে করেন মহিলারা গাড়ি চালাতে পারেন না। নারীদের স্থান বাড়ির মধ্যে এবং তারা মূলত পুরুষের সম্পত্তি। এমনকি ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষিতার উপরেও দায়বার্তায় বলেও ভিডিও করেছেন তিনি। নারীদের উপর আক্রমণের ইন্ধন যোগানোর ভিডিওগুলির ভিউ ছিল আকাশ ছোঁয়া।”
সত্যি বলতে কি, পৃথিবী এখন গ্লোবাল ভিলেজ। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে পৃথিবীর যে কোন জায়গার, যে কোন ঘটনা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। ফলে অ্যান্ড্রু টেট-এর মত মটিভেশনাল বক্তব্য যা নারীবিদ্বেষকে বাড়িয়ে দেয় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের দেশেও। রেডিট, instagram-এ চোখ রাখলেই এই তথ্য নজরে আসে হামেশাই।
এভাবে নতুন প্রজন্মের একাকীত্ব, হীনমন্যতা থেকে জন্ম নিচ্ছে হতাশা এবং তার থেকেই জন্ম নিচ্ছে ‘নারী বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ’। সম্প্রতি(গত শনিবার), উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদ থানা এলাকার ১৪ বছরের এক কিশোরের নিজের ৬ বছরের মামাতো বোনকে হত্যা করে পুকুরের ধারে মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেওয়ার ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে, সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও নারী বিদ্বেষের বিষ আমাদের দেশের কৈশোরকেও কীভাবে বিষিয়ে তুলেছে। ‘অ্যাডোলেসেন্স’ এখন আমাদের বাড়ির উঠানের রিয়েল স্ক্রিনে ভেসে উঠছে।
শময়িতা চক্রবর্তী তাঁর এই পর্যবেক্ষণটি তুলে ধরেছেন বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম ‘এই সময়ে’র সম্পাদকীয় পাতায় লেখা উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধে। নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে ৩০ শে চৈত্র রবিবার, ১৩ই এপ্রিল ২০২৫ সালের শহর সংস্করণে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন