আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে ড. মেঘনাথ সাহার বক্তব্য
আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে ড. মেঘনাথ সাহার বক্তব্য :
“বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র এবং হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব নিহিত আছে।”
— ড. মেঘনাথ সাহা
উক্তিটি ইংরেজিতে পড়ুন
উক্তিটির উৎস ও প্রসঙ্গ জানুন :
Dr. Meghnath Saha's statement on modern science and Hinduism
Dr.-Meghnath-Saha-s-statement-on-modern-science-and-Hinduism
মেঘনাদ সাহা (৬ অক্টোবর ১৮৯৩ – ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬) ছিলেন একজন ব্রিটিশ ভারতীয় বাঙালি বিজ্ঞানী, যিনি তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে সমগ্র বিশ্বে খ্যাতি অর্জন করেছেন। গণিত নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেও পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়েও তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ‘তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্ব’ তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আবিষ্কৃত ‘সাহা আয়নীভবন সমীকরণ’ নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌতধর্মগুলো ব্যাখ্যা করতে অপরিহার্য উপাদান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে। তিনি ভারতে নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানে আধুনিক গবেষণার জন্য ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ‘সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর অবদানের জন্য ১৯২৭ সালে লন্ডনের ‘রয়াল সোসাইটি’ তাঁকে এফআরএস নির্বাচিত করে।
১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি নতুন দিল্লির ‘বিড়লা হাউস’ প্রাঙ্গণে (এখন যেটা ‘গান্ধী স্মৃতি’ নামে পরিচিত) মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যাকারী ছিলেন নাথুরাম গডসে। তিনি কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল ‘হিন্দু মহাসভা’র সদস্য ছিলেন বলে বলা হয়। সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন হিন্দু জাতীয়তাবাদী আধাসামরিক স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে’র (আরএসএস) একজন প্রাক্তন সদস্যও।
গান্ধীজীর হত্যার পর কেন্দ্রীয় সরকার আরএসএসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে তারা তাদের মতাদর্শ প্রচারের জন্য স্কুল শিক্ষাকে নিরাপদ এবং কার্যকর ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়। দেশে একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে আরএস এস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত স্কুল বা বিদ্যালয়। তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রথম বিদ্যালয়টির নাম ছিল ‘শ্রীমদ্ভগবতগীতা বিদ্যালয়’। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের কুরুক্ষেত্র অঞ্চলে। বিদ্যালয়টি ১৯৪৬ সালে আরএসএস প্রধান এম এস গোলয়ালকর কর্তৃক উদ্বোধন করা হয়েছিল।
১৯৭৭ সালে আরএসএসের শিক্ষার শীর্ষ সংগঠন বিদ্যাভারতী
আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তা দ্রুততার সঙ্গে সারা ভারতে প্রসারিত হতে থাকে।
এই বিদ্যালয়ের ‘সংস্কৃতি বোধমালা সিরিজ’-এর পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় যে, ‘পরমাণু তত্ত্ব’-এর প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন প্রাচীন ভারতীয় ঋষি কনাদ। এরকমই বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে ভারতীয় মুনি ঋষীদের পথপ্রদর্শকের ভূমিকা রয়েছে বলে দাবি করা হয় তাদের এই সমস্ত পাঠ্যপুস্তকে। এপ্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ২০১৯ সালের জাতীয় শিক্ষা মন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল বলেন, “আমাদের ধর্মগ্রন্থে, নিউটনের আবিষ্কারের অনেক আগেই মহাকর্ষের ধারণার কথা উল্লেখ রয়েছে।” ঠিক এইরকমই লেখা রয়েছে ‘সংস্কৃত বোধমালার’ বইগুলিতে। এমনই একটি বইতে বলা হয়েছে পঞ্চম শতাব্দীর গণিতবিদ আর্যভট্ট এবং দ্বাদশ শতাব্দীর গণিতবিদ ভাস্করাচার্য সর্বপ্রথম মহাকর্ষের ধারণা প্রদান করেছিলেন।
এখানে মনে রাখা দরকার, আধুনিক বিজ্ঞান সংক্রান্ত এই ভাবনা এবং এ সংক্রান্ত বিতর্ক আজকের নতুন নয়। ব্রিটিশ ভারতে যখন ভারতের বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিজ্ঞান গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও গবেষণার সূত্র ধরে, তখনও এই দাবি করতেন আরএসএসের সহযোগী বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। এই সংগঠনগুলির বক্তব্যকে খন্ডন করার জন্য ভারতের বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডক্টর মেঘনাদ সাহা কলম ধরে ছিলেন। তাঁর মতে, এগুলি ছিল বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞান প্রচার। তিনি তাঁর ‘আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দু ধর্ম’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থে লিখেছেন,
“বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র এবং হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। ”
এই মন্তব্যের ঠিক পরেই তিনি লিখেছেন, “সকল প্রাচীন সভ্য দেশের পণ্ডিতগণই বিশ্বজগতে পৃথিবীর স্থান, চন্দ্র সূর্য গ্রহাদির গতি, রসায়নবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা ইত্যাদি সম্পর্কে নানারূপ কথা বলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও বাস্তবিকপক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত তিনশত বছরের মধ্যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যাবসায় প্রসূত। একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি, এদেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন আর নতুন কি করিয়াছে? কিন্তু এই সমস্ত “অল্পবিদ্যাভয়ংকরী” শ্রেণীর তাত্ত্বিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী ও অপরাপর গ্রহ সূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তীভাস (elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে একথা বলেন নাই। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপারাপর গ্রহের ভ্রমণ কক্ষ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং ভাস্করাচার্য বা কোন হিন্দু, গ্রীক বা আরবী পণ্ডিত কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের পূর্বেই মধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই কিছুই নয়। দুঃখের বিষয়, দেশে এইরূপ অপবিজ্ঞান প্রচারকের অভাব নাই, তাহারা সত্যের নামে নির্জলা মিথ্যার প্রচার করিতেছেন মাত্র।”
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন