ধর্মান্তরকরণ সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ
ধর্মান্তরকরণ সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ :
“আমার নিজের মত এই যে, ভারতের আদিবাসীগণ, বহিরাগত জাতিসমূহ এবং মুসলমানাধিকারের পূর্ববর্তী আমাদের প্রায় সকল বিজেতৃবর্গের পক্ষেই ওই কথা (তরবারিবলে ধর্মত্যাগে বাধ্য করা) প্রযুক্ত হইতে পারে। শুধু তাহাই নহে, পুরান সমূহে যে সকল জাতির বিশেষ উৎপত্তির বিষয় কথিত হইয়াছে, তাহাদের সম্বন্ধেও ওই কথা খাটে। আমার মতে, তাহারা অন্য ধর্মী ছিল, তাহাদিবকে হিন্দু করিয়া লাওয়া হইয়াছে।”
— স্বামী বিবেকানন্দউক্তিটি ইংরেজিতে পড়ুন
উক্তিটির উৎস ও প্রসঙ্গ জানুন :
Swami Vivekananda's quotes about conversion
Swami-Vivekanandas-quotes-about-Conversion
‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকার প্রতিনিধি ১৮৯৯ সালের এপ্রিল মাসে স্বামী বিবেকানন্দের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন। এই সাক্ষাতের মধ্যে তিনি এই মন্তব্যটি করেছিলেন। এই সাক্ষাৎকারটি পাওয়া যাবে ‘স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা’, নবম খন্ড, ‘হিন্দু ধর্মের সীমানা’ নামক রচনায়।
এই সাক্ষাৎকারের শিরোনাম দেয়া হয়েছিল ‘হিন্দু ধর্মের সীমানা’। এই সাক্ষাৎকারে পত্রিকার প্রতিনিধি স্বামীজিকে প্রশ্ন করেছিলেন, “স্বামীজী, যাহারা হিন্দুধর্ম ছাড়িয়া অন্য ধর্ম গ্রহণ করিয়াছে, তাহাদিগকে হিন্দু ধর্মে পুনর্গ্রহণ বিষয়ে আপনার মতামত কি জানিবার জন্য আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি। আপনার কি মত, তাহাদিগাকে আবার গ্রহণ করা যাইতে পারে?”
এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজি বলেছিলেন, ‘নিশ্চয়। তাহাদের অনায়াসে গ্রহণ করা যাইতে পারে, করা উচিতও।’ প্রতিবেদক লিখছেন, এরপর তিনি মুহূর্তকাল গম্ভীরভাবে চিন্তা করিয়া বলিতে আরম্ভ করলেন —
“আর এক কথা তাহাদিগকে পুনর্গ্রহণ না করিলে আমাদের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাইবে। যখন মুসলমানেরা প্রথমে এদেশে আসিয়াছিলেন, তখন প্রাচীনতম মুসলমানের ঐতিহাসিক ফেরিস্তার মতে, ভারতের ৬০ কোটি হিন্দু ছিল, এখন আমরা ২০ কোটিতে পরিণত হইয়াছি। আর কোন লোক হিন্দু সমাজ ত্যাগ করলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে তাহা নয়, একটি করিয়া শত্রু বৃদ্ধি হয়!
তারপর আবার হিন্দু ধর্ম ত্যাগী মুসলমান বা খ্রিস্টানের মধ্যে অধিকাংশই তরবারিবলে ওই সব ধর্ম গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছে, অথবা যাহারা ইতিপূর্বে ওইরুপ করিয়াছে তাহাদেরই বংশধর। ইহা দিকের হিন্দু ধর্মে ফিরে আসিবার পক্ষে নানা রূপ আপত্তি উত্থাপন করা বা প্রতিবন্ধকতা করা স্পষ্টই অন্যায়। আর যাহারা কোন কালে হিন্দু সমাজভুক্ত ছিল না, তাহাদের সম্বন্ধে কি আপনি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন? দেখুন না, অতীতকালে এইরূপ লক্ষ লক্ষ বিধর্মীকে হিন্দু ধর্মে আনা হইয়াছে আর এখনও সেরূপ চলিতেছে।”
এরপরই তিনি বলছেন, (প্রতিবেদক উদ্ধৃত করছেন), “আমার নিজের মত এই যে, ভারতের আদিবাসীগণ, বহিরাগত জাতিসমূহ এবং মুসলমানাধিকারের পূর্ববর্তী আমাদের প্রায় সকল বিজেতৃবর্গের পক্ষেই ওই কথা প্রযুক্ত হইতে পারে। শুধু তাহাই নহে, পুরান সমূহে যে সকল জাতির বিশেষ উৎপত্তির বিষয় কথিত হইয়াছে, তাহাদের সম্বন্ধেও ওই কথা খাটে। আমার মতে, তাহারা অন্য ধর্মী ছিল, তাহাদিবকে হিন্দু করিয়া লাওয়া হইয়াছে।”
এরপর তিনি ইচ্ছাপূর্বক ধর্মান্তর গ্রহণকারী হিন্দু সমাজে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে প্রায়শ্চিত্ত করা উচিত কিনা তার ব্যাখ্যা দেন। তাঁর কথায়, “যাহারা ইচ্ছা পূর্বক ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল, কিন্তু এখন হিন্দু সমাজে ফিরে আসিতে চায়, তাহাদের পক্ষে প্রায়শ্চিত্ত ক্রিয়া আবশ্যক, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু জাহাদিগকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হইয়াছিল, যেমন কাশ্মীর ও নেপাল অনেককে দেখা যায়, অথবা যাহারা কখনো হিন্দু ছিল না, এখন হিন্দু সমাজে প্রবেশ করিতে চায়, তাহাদের পক্ষে কোনরূপ প্রায়শ্চিত্ত ব্যবস্থা করা উচিত নহে।”
এই উত্তর পাওয়ার পর প্রতিবেদক সাহস করে যে প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করলেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “স্বামীজি, কিন্তু ইহা কোন জাতি হইবে? তাহাদের কোন-না-কোনরূপ জাতি থাকা আবশ্যক, নতুবা কখনও বিশাল হিন্দু সমাজের অঙ্গীভূত হইতে পারিবে না। হিন্দু সমাজে তাহাদের যথার্থ স্থান কোথায়?”
প্রতিবেদকের কথায় —
স্বামীজি ধীরভাবে বলিলেন, “যাহারা পূর্বে হিন্দু ছিল, তাহারা অবশ্য তাহাদের জাতি ফিরিয়া পাইবে। আর যাহারা নতুন, তারা নিজের জাতি নিজেরাই করিয়া লইবে।”
তিনি আরও বলিতে লাগিলেন ‘স্মরণ রাখিবেন, বৈষ্ণব সমাজে ইতিপূর্বেই এই ব্যাপার ঘটিয়াছে এবং অহিন্দু ও হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন জাতি হইতে যাহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল, সমাজের আশ্রয় লাভ করিয়া নিজেদেরই একটা জাতি গঠন করিয়া লইয়া ছিল, আর সে জাতি বড়হীন জাতি নহে, বেশ ভদ্র জাতি। রামানুজ হইতে আরম্ভ করিয়া বাংলাদেশে শ্রীচৈতন্য পর্যন্ত সকল বড় বড় বৈষ্ণব আচার্যই ইহা করিয়াছেন’
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এই নতুন যাহারা আসিবে, তাহাদের বিবাহ কোথায় হইবে?
স্বামীজি স্থির ভাবে বলিলেন, —এখন যেমন চলিতেছে, নিজেদের মধ্যেই।’
আমি বলিলাম, ‘তারপর নামের কথা। আমার বোধহয়, অহিন্দু এবং যেসব সাধারণ ত্যাগী অহিন্দু নাম লইয়াছিল, তাহাদের নতুন নামকরণ করা উচিত। তাহাদিগকে কি জাতিসূচক নাম বা আর কোন প্রকার নাম দেওয়া যাইবে?’
স্বামীজীর চিন্তা করিতে করিতে বলিলেন, ‘অবশ্য নামের অনেকটা শক্তি আছে বটে।’
কিন্তু তিনি এই বিষয়ে আর অধিক কিছু বলিলেন না। কিন্তু তারপর আমি যাহা জিজ্ঞাসা করিলাম, তাহাতে তাহার আগ্রহ যেন উদ্দীপ্ত হইল। প্রশ্ন করিলাম, ‘স্বামীজি, এই নবাগন্তুকগণ কি হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন প্রকার শাখা হইতে নিজেদের ধর্ম প্রণালী নিজেরাই নির্বাচন করিয়া লইবে অথবা আপনি তাহাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট ধর্মপ্রণালী নির্বাচন করিয়া দিবেন?’
স্বামীজি বলিলেন, ‘একথা কি আবার জিজ্ঞাসা করিতে হয়? তাহারা আপন আপন পথ নিজেরাই বাছিয়া লইবে। কারণ, নিজে নির্বাচন করিয়া না লইলে হিন্দু ধর্মের মূলভাবটিই নষ্ট করা হয়। আমাদের ধর্মের সার এইটুকু যে, প্রত্যেকের নিজ নিজ ইষ্ট নির্বাচনের অধিকার আছে।’
আমি এই কথাটি বিশেষ মূল্যবান বলিয়া মনে করিলাম। কারন আমার বোধ হয়, আমার সম্মুখস্থ এই ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা বৈজ্ঞানিকভাবে ও সহানুভূতির দৃষ্টিতে হিন্দু ধর্মের সাধারণ ভিত্তি সমূহের আলোচনায় অনেকদিন কাটাইয়া ছিলেন। আর ইষ্ঠ নির্বাচনের স্বাধীনতা রূপ তত্ত্বটি এত উদার যে, সমগ্র জগতকে ইহার অন্তর্ভুক্ত করা যাইতে পারে।
--------xx--------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন