হিন্দু মুসলমান সম্পর্কে আলী হোসেনের মন্তব্য
হিন্দু ও মুসলমান ধর্ম সম্পর্কে আলী হোসেনের মন্তব্য :
“হিন্দু যেমন কোনো ধর্ম নয়, তেমনি মুসলমান কোন জাতি নয়। হিন্দু যেমন একটা জাতিসত্তার নাম, মুসলমান তেমনি একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিন্ন কিছু নয়। তবে এদেশে উভয়ের জাতীয়তা হল ভারতীয় বা ইন্ডিয়ান”
— আলী হোসেন
এই উক্তিটি ইংরেজিতে পড়ুন
এই উক্তিটির উৎস ও প্রসঙ্গ জানুন :
Ali Hossain's comments on Hindus and Muslims
Ali-Hossains-comments-on-Hindus-and-Muslims
হিন্দু যেমন কোনো ধর্ম নয়, তেমনি মুসলমান কোন জাতি নয়। মনে রাখতে হবে, হিন্দু একটা জাতিসত্তার নাম। অন্যদিকে মুসলমান একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় ভিন্ন কিছু নয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল হল, এদের উভয়েরই জাতীয়তা বা জাতিসত্ত্বা এক। এই জাতীয়তা বা জাতিসত্ত্বার মধ্যযুগীয় নাম ছিল হিন্দু, তার আধুনিক রূপ হল, ভারতীয় বা ইন্ডিয়ান।
ধর্ম হল খানিকটা পোশাকের মত। যে পোশাকে মানুষ সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, সেটাই মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। সেটাই হয়ে ওঠে প্রিয় পোশাক। কোন পোশাক যদি আমাকে কষ্ট দেয়, তবে আমি চেষ্টা করি তাকে বর্জন করার এবং আরামদায়ক পোশাককে আপন করার। তাই পারিবারিক বা সামাজিক কোন বাধা না থাকলে, মানুষ নতুন কোন পোশাককে হামেশাই গ্রহণ বা পুরনোকে বর্জন করে ফেলে। এ কারণেই, আমরা ইতিহাসের পাতায় ধর্মহীন মানুষকে ধার্মিক হয়ে উঠতে দেখেছি। প্রথমে দেখেছি প্রকৃতিকে ঈশ্বর জ্ঞানে মন্ত্র পাঠের মাধ্যমে আরাধনা করতে। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর মতে, "বৈদিককালে কোন মূর্তি বানানো হতো না। দেবতারা ছিলেন মন্ত্রমূর্তি। মন্ত্রদিয়েই তাদের অবয়ব কল্পনা করা হত।" এরপর দেখেছি প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তিকে নির্দিষ্ট অবয়ব দিয়ে প্রার্থনা করার প্রচলন হতে। এই পর্বে জন্ম নিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির জন্য ভিন্ন ভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। এরপর এদেরকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় মতাদর্শ এলো। ফলে ধর্মকে কেন্দ্র করে মনুষ্য জাতি বিভক্ত হতে শুরু করল। বাঁধলো পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের হাত থেকে মুক্তি পেতে জন্ম নিল একেশ্বরবাদ। ইউরোপের বহুত্ববাদী মানুষ পেগান ধর্ম ত্যাগ করে গ্রহণ করল একেশ্বরবাদী খ্রিষ্টান ধর্ম। এই পথেই একদিন এলো ইসলাম। এভাবেই বিশ্বজুড়ে মানুষ সময় ও চিন্তার পরিবর্তনের সূত্র ধরে এক ধর্মের জামা খুলে, নতুন কোন জামা পরেছে।
ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। এক ব্রহ্মা তেত্রিশ কোটি দেবতায় (অবতারে) বিভাজিত হয়েছে। এরপর একেশ্বরবাদের প্রচার ও প্রসার ঠেকাতে জন্ম নিয়েছে সমন্বয়বাদী ধর্ম। আমরা চৈতন্য থেকে রামকৃষ্ণ, কবির থেকে নানককে পেয়েছি এই পর্বে। এক সময়ের ধর্মহীন চার্বাক, কিম্বা পরবর্তীকালে অবিশ্বাসী বৌদ্ধ ও জৈন মানস, ক্ৰমান্বয়ে প্রকৃতি পূজারী (যদিও সমগ্র বেদে মাত্র একবার 'পূজা' শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে - নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুরি) থেকে ভক্তি ও সুফীবাদে আশ্রয় নিয়েছে। এই পাল্টে যাওয়াটা মানুষের খুব স্বাভাবিক প্রবণতা। চিন্তা চেতনার বিকাশের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণেই প্রথম জীবনের গভীর ধর্মবিশ্বাসী মানুষ শেষ জীবনে নাস্তিক হয়েছেন, ধর্মকে পাত্তা না দেওয়া মানুষ হয়ে গেছেন ধার্মিক - এ দৃষ্টান্ত আমার আপনার চারপাশেই রয়েছে।
একটু খেয়াল করলেই জানতে পারি, একটু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করলেই বুঝতে পারি, এভাবে মানুষের ধর্মবোধ সহজে পাল্টে গেলেও তার মধ্যে যে নৃতাত্ত্বিক গঠন থাকে, তা কখনোই পাল্টায় না। কারণ এই নৃতাত্ত্বিক গঠন নির্ভর করে মানবজাতির ডিএনএ-এর গঠনের উপর, যা কখনই আমূল পাল্টে ফেলা যায় না। এবং তাকে কেন্দ্র করে যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে, কোন নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায়, তাও সহজে পাল্টায় না। ইউরোপের তথাকথিত উন্নত এবং সভ্য জাতি বলে দাবি করা মানুষ (উপনিবেশিকরা) তাই পৃথিবীর 'নতুন দেশ' নামে পরিচিত উপনিবেশগুলির আদিম জনজাতিকে একারণেই পাল্টাতে পারেনি। যন্ত্র সভ্যতার অসীম শক্তি ব্যবহার করে তাই তাদেরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে চিরতরে মুছে গেছে ইনকা ও মায়া সভ্যতা নামে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার দুটো প্রাচীন সভ্যতা। একইভাবে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সহ অধিকাংশ উপনিবেশ থেকে আদিবাসীদের তারা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, হিন্দু কোন ধর্ম নয় কেন? প্রথমত, হিন্দু যদি ধর্ম হত, তবে এই ধর্মের যে সকল প্রাচীন গ্রন্থ (ধর্মগ্রন্থ) আছে তাতে 'হিন্দু' শব্দের অস্তিত্ব থাকত। থাকতো তার উৎপত্তি ও বেড়ে ওঠার ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা। বেদ থেকে পুরান ---কোন গ্রন্থেই হিন্দু শব্দের উপস্থিতি নেই, নেই কোন ব্যাখ্যাও। দ্বিতীয়ত, এই শব্দটি বিদেশী শব্দ। শুধু তাই নয়, এর ব্যবহার প্রথম যারা করেছেন, তারাও বিদেশি। ভারতীয় উপমহাদেশের জনজাতিকে তারা হিন্দু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাদের বিভিন্ন গ্রন্থে।
অন্যদিকে, মুসলমান একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়, যাদের ধর্ম হল ইসলাম। ইসলাম ধর্মের প্রামান্য গ্রন্থ (ধর্মগ্রন্থ) কোরআন শরীফে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, যারা এই ধর্মে বিশ্বাস করেন, তারা সবাই মুসলমান। সুতরাং মুসলমান একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়। জাতি নয়। তারা যে অঞ্চলে বসবাস করেন, সেই অঞ্চলের জাতিসত্তাই তাদের জাতীয়তা। তাই স্বাধীনতা উত্তর হিন্দুস্থানে বসবাসকারী সমগ্র মুসলমান নিজেদের হিন্দুস্তানি নামে চিহ্নিত করেছে। স্বাধীনতাপূর্ব ভারতীয় সাহিত্যে তার ভুরি ভুরি নজির রয়েছে। আজ স্বাধীন হিন্দুস্থানের নাম হয়েছে ভারত বা ইন্ডিয়া। ভারতে বসবাসকারী মুসলমান তাই আজ ভারতীয়। প্যালেস্টাইনের বসবাসকারীরা মুসলমান যেমন প্যালেস্টানিয়, একই রকমভাবে পাকিস্তানের মুসলমান পাকিস্তানি, বাংলাদেশর বাংলাদেশী।
এবারে আসুন, কেন 'মুসলমান' শব্দটি জাতিগত চরিত্রের চিহ্ন নয়? তার কারণ হল, জাতি বা জাতিসত্তার সঙ্গে দুটি বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এর মধ্যে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। এবং দ্বিতীয়টি হল, নৃতাত্ত্বিক গঠনগত বৈশিষ্ট্য, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, যা কখনোই পাল্টানো যায় না।
সংস্কৃতির সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার মানুষের বিশ্বাস এবং জীবনচর্চার ধরণধারণের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ক ছিন্ন করা খুবই কঠিন কাজ। আর এ কারণেই অঞ্চল ভেদে একই ধর্মের মানুষের বিশ্বাস ও জীবন চর্চা ভিন্ন ভিন্ন ধরন লক্ষ্য করা যায়। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষদের মধ্যে তাই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র বিদ্যমান। এবং এ কারণেই প্যান ইসলামইজমের ধারণাটি দীর্ঘদিন ধরে প্রচারে থাকলেও তা বাস্তব রূপ পায়নি। ১৯২৮ সালে মিশরের হাসান আল বান্নার তৈরি 'মুসলিম ব্রাদারহুড'-এর ধারণাও এগোয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকালে, গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে, বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। স্বর্ণযুগের ইসলামিক (আরবীয় অথবা তুর্কি) সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এই টুকরো হয়ে যাবার পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ হল, জাতিসত্ত্বা সম্পর্কে চেতনার জন্ম ও তার বিকাশ। মুখে আরবীয় জাতিসত্তা ও মুসলিম ব্রাদারহুড-এর কথা বললেও তা কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়েছে আঞ্চলিক জাতিসত্তার কাছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত গোষ্ঠীগুলো নিজেদের আরবীয় বলার চেয়ে প্যালেস্তানিয় বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। অন্যদিকে সেখানে ইসরাইল কর্তৃক হাজার হাজার মানুষের নৃশংস হত্যা হওয়া, এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের প্রায় সকলের চোখ বুজিয়ে থাকার ঘটনাও আঞ্চলিক জাতিসত্তাকে প্রাধান্য দেওয়ার দিকেই মনোযোগ নিবদ্ধ করে।
ইউরোপীয় নবজাগরণ ও তৎপরবর্তী ফরাসি বিপ্লব প্রসূত জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণা এই বিশেষ জাতিসত্তার বোধ গড়ে তুলেছে। এই জাতিসত্তার জন্ম এবং বিকাশের কারণেই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলো ভেঙে ছোট ছোট জাতি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। আজকের ইউরোপের দিকে তাকালেই এই জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও তাদের ভিন্ন ভিন্ন গঠন চোখে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা তার পররাষ্ট্র নীতিতে ট্রূম্যান নীতির প্রয়োগ জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনকে উৎসাহিত করে এবং মার্শাল প্লানের (আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে দেশের পুনর্গঠনে সাহায্য করা) মাধ্যমে তাকে টিকিয়ে রাখার নীতি গ্রহণ করে। ফলে বহুজাতিক ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে, ন্যাটো চুক্তির মাধ্যমে এই সমস্ত ছোট ছোট রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা করে আমেরিকা তাদেরকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলে।
এখন প্রশ্ন হতে পারে, ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসত্তার যে ধরন, তা কি ভারতীয় জাতিসত্তার ধরনের সঙ্গে মেলে? উত্তর হল, না মেলে না। যদি এক হতো, তবে সমগ্র ভারত মধ্যপ্রাচ্যের মতো বহু ছোট ছোট দুর্বল জাতিরাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যেত। ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান / বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’ — কবিগুরুর এই স্বপ্নের ভারত বাস্তবে মাথা তুলতে পারত না। ১৯৪৭ সালের ভারতের স্বাধীনতা আইনের বিধানগুলিতে ভারতকে মধ্যপ্রাচ্যের মতো দুর্বল জাতি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে ফেলার যাবতীয় ব্যবস্থাই রাখা হয়েছিল। ভারত ও পাকিস্তান ভাগ করার সাথে সাথে এই আইনের মধ্যে দেশীয় রাজ্যগুলির জন্য ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দেওয়ার বিকল্প হিসেবে স্বাধীন থাকার অপশনও খুলে রাখা হয়েছিল।
সুতরাং ভারতীয় জাতিসত্তার চরিত্র ইউরোপীয় জাতিসত্তার চরিত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এই জাতিসত্তার ধাত্রীভূমি ইউরোপ নয়, আমেরিকা ও রাশিয়া। আধুনিক রাষ্ট্রনীতিতে যা বহুজাতিক ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো নামে পরিচিত। এটাই আধুনিক পৃথিবীতে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সবচেয়ে উপযুক্ত পথ। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের সরকার যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এই বহুজাতিক জাতিসত্তার ধারণাকে শক্তিশালী করে। ফলে, দেশ আজ এক বৃহৎ ও বহুজাতিক রাষ্ট্রের চেহারা নিতে পেরেছে। সেই সঙ্গে সকল ধর্মের মানুষ এক জাতীয়তার (যা মধ্যযুগে হিন্দু জাতি এবং বর্তমানে ভারতীয়) ছত্রছায়ায় জড়ো হতে পেরেছে এবং সকলেই এক ভারতীয় জাতি হিসাবে নিজে অনুভব করতে পেরেছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন