কবি ও কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর :
কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
“যে কবি সে মনের ভিতর হইতে কবিতা পায়, যে কবি নয় সে অন্যের কাছ হইতে কবিতা নেয়।”
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উক্তিটি ইংরেজিতে পড়ুন
উক্তিটির উৎস ও প্রসঙ্গ জানুন :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুরঙ্গ উপন্যাসের শ্রীবিলাস চরিত্রের মুখ দিয়ে এই উক্তিটি উচ্চারিত হয়েছে। শ্রীবিলাস শচীশকে উদ্দেশ্য করে এই মন্তব্যটি করেছিলেন।
উপন্যাস চতুরঙ্গ, চরিত্র শ্রী বিলাস (৪), দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, পৃষ্ঠা নম্বর ৩৭।
Rabindranath Tagore on Poets and Poetry
Rabindranath-Tagore-on-Poets-and-Poetry
যাই বল, আমি শচীশের এই সাধনার ব্যাকুলতা বুঝিতে পারি না। একদিন তো এ জিনিসটাকে হাসিয়া উড়াইয়া দিয়াছি, এখন আর যাই হোক হাসি বন্ধ হইয়া গেছে। আলেয়ার আলো নয়, এই যে আগুন। শচীশের মধ্যে ইহার দহতা যখন দেখিলাম তখন ইহাকে লইয়া জ্যাঠামশাইয়ের জেলাগিরি করিতে আর সাহস হইল না। কোন্ ভুতের বিশ্বাসে ইহার আদি এবং কোন্ অদ্ভুত এর বিশ্বাসে ইহার অন্তর তাহা লইয়া হারবার্ট স্পেন্সারের সঙ্গে মোকাবেলা করিয়া কি হইবে — স্পষ্ট দেখিতেছি শচীশ জলিতেছে, তার জীবনটা একদিক হইতে আর-এক দিক পর্যন্ত রাঙা হইয়া উঠিল।
এতদিন সে নাচিয়া গাহিয়া কাঁদিয়া গুরুর সেবা করিয়া দিনরাত অস্থির ছিল, সে এক রকম ভালো। মনের সমস্ত চেষ্টা প্রত্যেক মুহূর্তে ফুকিয়া দিয়া একেবারে সে নিজেকে দেউলে করিয়া দিত। এখন স্থির হইয়া বসিয়াছে, মনটাকে আর চাপিয়া রাখিবার জো নাই। আর ভাব-সম্ভোগে তলাইয়া যাওয়া নয়, এখন উপলব্ধিতে প্রতিষ্ঠিত হইবার জন্য ভিতরে ভিতরে এমন লড়াই লড়িতেছে যে তার মুখ দেখিলে ভয় হয়।
আমি একদিন আর থাকিতে পারিলাম না; বলিলাম, দেখো শচীশ, আমার বোধহয় তোমার একজন কোন গুরুর দরকার যার উপরে ভর করিয়া তোমার সাধনা সহজ হইবে।
শচীশ বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, চুপ কর বিশ্রী, চুপ কর — সহজকে কিসের দরকার? ফাঁকিই সহজ, সত্য পথ দেখাইব—
শচীশ অধীর হইয়া বলিল, ওগো, এ তোমার ভূগোল বিবরণের সত্য নয়, আমার অন্তর্যামী কেবল আমার পথ দিয়াই আনাগোনা করেন — গুরুর পথ গুরুর আঙিনাতেই যাওয়ার পথ।
এই এক শচিশের মুখ দিয়া কতবার যে কত উল্টো কথাই শোনা গেল! আমি শ্রীবিলাস, জ্যাঠামশায়ের চ্যালা বটে, কিন্তু তাঁকে গুরু বলিলে তিনি আমাকে চ্যালাকাঠ লইয়া মারিতে আসিতেন। সেই আমাকে দিয়া শচীশ গুরুর পা টিপাইয়া লইল, আবার দুদিন না যাইতেই সেই আমাকেই এই বক্তৃতা! আমার হাসিতে সাহস হইল না, গম্ভীর হইয়া রইলাম।
শচীশ বলিল, আজ আমি স্পষ্ট বুঝিয়াছি, স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ কথাটার অর্থ কী। আর-সব জিনিস পরের হাত হইতে লওয়া যায়, কিন্তু ধর্ম যদি নিজের না হয় তবে তাহা মারে, বাঁচায় না। আমার ভগবান অন্যের হাতের মুষ্টিভিক্ষা নহেন; যদি তাঁকে পাই তো আমিই তাঁকে পাইব, নহিলে নিধনং শ্রেয়ঃ।
তর্ক করা আমার স্বভাব, আমি সহজে ছাড়িবার পাত্র নই; আমি বলিলাম, যে কবি সে মনের ভিতর হইতে কবিতা পায়, যে কবি নয় সে অন্যের কাছ হইতে কবিতা নেয়।
শচীশ অম্লান মুখে বলিল, আমি কবি।
বাস্—চুকিয়া গেল, চলিয়া আসিলাম।
শচীশের খাওয়া নাই, শোওয়া নাই, কখন কোথায় থাকে হুঁশ থাকে না। শরীরটা প্রতিদিনই যেন অতি-শান-দেওয়া ছুরির মতো সূক্ষ্ম হইয়া আসিতে লাগিল। দেখিলে মনে হইত আর সহিবে না। তবু আমি তাকে ঘাঁটাইতে সাহস করিতাম না। কিন্তু দামিনী সহিতে পারিত না। ভগবানের উপরে সে বিষম রাগ করিত—যে তাঁকে ভক্তি করে না তার কাছে তিনি জব্দ, আর ভক্তের উপর দিয়াই এমন করিয়া তার শোধ তুলিতে হয় গা? লীলানন্দস্বামীর উপর রাগ করিয়া দামিনী মাঝে মাঝে সেটা বেশ শক্ত করিয়া জানান দিত, কিন্তু ভগবানের নাগাল পাইবার উপায় ছিল না।
তবু শচীশকে সময়মত নাওয়ানো-খাওয়ানোর চেষ্টা করিতে সে ছাড়িত না। এই খাপছাড়া মানুষটাকে নিয়মে বাঁধিবার জন্য সে যে কতরকম ফিকিরফন্দি করিত তার আর সংখ্যা ছিল না।
অনেক দিন শচীশ ইহার স্পষ্ট কোনো প্রতিবাদ করে নাই। একদিন সকালেই নদী পার হইয়া ওপারে বালুচরে সে চলিয়া গেল। সূর্য মাঝ আকাশে উঠিল, তার পরে সূর্য পশ্চিমের দিকে হেলিল, শচীশের দেখা নাই। দামিনী অভুক্ত থাকিয়া অপেক্ষা করিল, শেষে আর থাকিতে পারিল না। খাবারের থালা লইয়া হাঁটুজল ভাঙিয়া সে ওপারে গিয়া উপস্থিত।
চারি দিকে ধূ ধূ করিতেছে, জনপ্রাণীর চিহ্ন নাই। রৌদ্র যেমন নিষ্ঠুর, বালির ঢেউগুলাও তেমনি। তারা যেন শূন্যতার পাহারাওয়ালা, গুঁড়ি মারিয়া সব বসিয়া আছে।
যেখানে কোনো ডাকের কোনো সাড়া, কোনো প্রশ্নের কোনো জবাব নাই, এমন একটা সীমানাহারা ফ্যাকাশে সাদার মাঝখানে দাঁড়াইয়া দামিনীর বুক দমিয়া গেল। এখানে যেন সব মুছিয়া গিয়া একেবারে গোড়ার সেই শুকনো সাদায় গিয়া পৌঁছিয়াছে। পায়ের তলায় কেবল পড়িয়া আছে একটা ‘না’। তার না আছে শব্দ, না আছে গতি; তাহাতে না আছে রক্তের লাল, না আছে গাছপালার সবুজ, না আছে আকাশের নীল, না আছে মাটির গেরুয়া। যেন একটা মড়ার মাথার প্রকাণ্ড ওষ্ঠহীন হাসি; যেন দয়াহীন তপ্ত আকাশের কাছে বিপুল একটা শুষ্ক জিহ্বা মস্ত একটা তৃষ্ণার দরখাস্ত মেলিয়া ধরিয়াছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন