ধর্মান্তরকরণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ধর্মান্তরকরণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Rabindranath Tagore on conversion
প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃস্টান হতে চলেছে। কিন্তু ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রীমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলেমা পড়াবে তখন পরিতাপ করার সময় থাকবে না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উক্তিটি ইংরেজিতে পড়ুন
উক্তিটির উৎস ও প্রসঙ্গ জানুন :
(হেমন্তীবালা দেবীকে লেখা চিঠি, ১৬.১০.১৯৩৩, চিঠিপত্র-৯)কল্যাণীয়াসুতুমি নিজেকে অত্যন্ত মিথ্যা পীড়ন কর। তোমার প্রতি আমার লেশমাত্র রোষ বা অবজ্ঞার ভাব নেই সে তুমি নিশ্চয় জানো তবু থেকে থেকে নিজের মধ্যে একটা বিপ্লব বাধিয়ে তোলো। তোমাকে উপলক্ষ্য করে আমি অনেক কথা বলি কিন্তু তোমাকে বলি নে। দেশের অসীম দুর্গতির কথায় মন যখন উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে তখন চুপ করে থাকতে পারি নে। ধর্ম্মে ও নিরর্থক আচারে হিন্দুকে শতধা বিভক্ত করে রেখেচে, বিদেশীর হাতে তাই পরাভবের পর পরাভব ভোগ করে আসচি। অন্তঃশত্রু এবং বহিঃশত্রুর হাতে মার খেয়ে খেয়ে আমাদের হাড় জীর্ণ। মুসলমান, ধর্ম্মে এক, আচারে এক, বাংলার মুসলমান, মাদ্রাজের মুসলমান, পাঞ্জাবের মুসলমান এবং ভারতবর্ষের বাইরের মুসলমান সমাজে সবাই এক, বিপদে আপদে সবাই এক হয়ে দাঁড়াতে পারে এদের সঙ্গে ভাঙাচুরো হিন্দুজাত পারবে না। আরো একবার আফগানিস্থানের পাঠানদের হাতে কানমলা খাবার দিন ঘনিয়ে আসচে। পি, সি, রায় অরণ্যে রোদন করচেন, বলছেন বাঙালীর অন্ন পরের হাতে যাচ্চে। কিন্তু বাংলার মুসলমানরা পিছয় নি— দেশে বিদেশে তাদের দেখেচি জীবিকা উপার্জ্জনে— কেননা বিধিনিষেধের নাগপাশ তাদের হাজার পাকে জড়িয়ে রাখে নি। মজ্জাগত অনৈক্যজনিত দুর্ব্বলতা এবং সহস্রবিধ বিধিনিষেধের বোঝা ঘাড়ে করে এই জাত বাঁচবে কী করে? সামাজিক অসম্মান থেকে বাঁচবার জন্যে প্রতিদিন নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরা মুসলমান এবং খৃষ্টান হতে চলেচে— কিন্তু ভাটপাড়ার চৈতন্য নেই। একদা ঐ তর্করত্নদের প্রপৌত্রমণ্ডলীকে মুসলমান যখন জোর করে কলমা পড়াবে তখন পরিতাপ করবারও সময় থাকবে না।
এই সব মনের দুঃখ তোমার কাছে মাঝে মাঝে ভাষায় প্রকাশ করি তাতে ক্ষতি হয়েচে কি? দেশের কথা চিন্তা করে যে কঠিন আঘাত আমাকে বাজচে সেটা তুমি ভেবে দেখ না কেন? দেশের জন্যে আমি তোমাকেও ভাবাতে চাই— তুমি কি দেশের মেয়ে নও? ব্যক্তিগতভাবে তোমাকে বেদনা দিতে আমার একটুও ভালো লাগে না— কিন্তু বিধাতার অভিসম্পাতে যে বেদনা প্রায় বিশকোটি হিন্দুর প্রাপ্য চোখ বুজে নিজেকে ভুলিয়ে তুমি তার থেকে নিষ্কৃতি পাবে কী করে? এ সমস্ত ন্যায়শাস্ত্রের তর্ক নয়— এ সমস্ত দুর্ভাবনা চতুর্দ্দিকব্যাপী সুকঠোর বাস্তবতার উপরে প্রতিষ্ঠিত। রাষ্ট্রিক অধিকারের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে আড়োচনা চল্চে আজকাল— যেন লঙ্কাভাগ করতে বসেচি অথচ সমস্ত লঙ্কাই যাচ্চে তলিয়ে। তুমি তো সন্তানের জননী, হিন্দুসমাজের ভবিষ্যৎ তোমার ছেলেমেয়েদের দুর্ব্বল স্কন্ধে চাপিয়ে দিয়ে একদিন তুমি চলে যাবে। কিন্তু সে কী ভবিষ্যৎ, ভেবে দেখো।
আমার এই সমস্ত কথা শুনে কখনো মনে কোরো না তোমার প্রতি আমি নির্ম্মম। তোমার আচার বিচার যেমনি হোক্ না কেন তোমাকে আমি স্নেহ করতে পারব না আমার হৃদয় এত কৃপণ নয়। আমার প্রতি বিশ্বাস রেখো এবং ভুল বুঝে নিজেকে পীড়ন কোরো না। ইতি ১৬ অক্টোবর ১৯৩৩
দাদা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন