মুসলমান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্য
মুসলমান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্য :
যে মুসলমানকে আজ ওরা প্রশ্রয় দিচ্ছে সেই মুসলমানেরাই একদিন মুষল ধরবে।
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উক্তিটি ইংরেজিতে পড়ুন
উক্তিটির উৎস ও প্রসঙ্গ জানুন :
অমিয় চক্রবর্ত্তীকে লেখা চিঠি, ১৫.১১.১৯৩৪, চিঠিপত্র : ১১)
Rabindranath Tagore's comments about Muslims
Rabindranath-Tagores-comments-about-Muslims
কল্যাণীয়েষু,
এইমাত্র তোমার প্রেরিত দুখানা প্যাম্ফলেট শেষ করে তোমাকে লিখতে বসলুম। মাদ্রাজ থেকে তোমাকে একখানা চিঠি পাঠিয়েছি বোধ হয় পেয়েচ। ভারতবর্ষের প্রদেশে প্রদেশে নাচগান বর্ষণ করে বেড়ানো এই আমার এক কাজ হয়েচে। হাসি পায় মনে করলে যখন ভাবি এই সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রনেতারা সমস্ত দেশ জুড়ে বক্তৃতামঞ্চে কন্গ্রেসের উত্তেজনা বিস্তার করে বেড়াচ্ছেন, তার গুরুত্ব সম্বন্ধে কারো মনে কোনো সন্দেহমাত্র নেই। কিন্তু কী স্তূপাকার অবাস্তবতা, কৃত্রিমতা। এক প্রদেশের সঙ্গে আর এক প্রদেশের অনেক কেবল ভাষাগত নয় স্থানগত নয় মজ্জাগত। পরস্পরের মানবসম্বন্ধ কেবল যে শিথিল তা নয়, অনেকস্থলেই বিরুদ্ধ। আমরা ভোটর ভাগ বিভাগ নিয়ে তুমুল তর্ক বাধিয়েছি, যেন অন্তরের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাক্লেও ভোটের সামঞ্জস্যে এই ফাটল ধরা দেশের সর্বনাশ নিবারণ করতে পারবে। আজকাল আমি সমস্ত ব্যাপারটাকে নিস্পৃহ বৈজ্ঞানিকভাবে দেখবার চেষ্টা করি; মরবার কারণ যেখানে আছে সেখানে মরেই এর চেয়ে সহজ কথা কিছুই নেই। পার্লামেন্টরি রাষ্ট্রতন্ত্র! একি বিলিতি দাওয়াইখানা থেকে ভিক্ষে করে আন্লেই তখনি আমাদের ধাতের সঙ্গে মিলে যাবে! নিয়ুয়র্কের আকাশ-আঁচড়া বাড়ি আমাদের পলিমাটির উপর বসিয়ে দিলে সেটা তার অধিবাসীদের কবর হয়ে উঠবে। সাদা কাগজের মোড়কে আমাদের ভাগে কী দান কী পরিমাণে এসে পৌঁছল সেটা বেশি কথা নয়, যাকে দেওয়া হচ্চে তারি পাঁচ আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে গলে গিয়ে কতটা টেকে সেইটেই ভাববার বিষয়। সত্যি কথা বল্তে গেলে আমার আশ্চর্য্য বোধ হয় যে আমাদের এতখানি দিতে প্রস্তুত হয়েচে। সন্দেহ নেই যে এই দেওয়াটাই শেষ কথা নয়, এটা আমাদের ভবিষ্যতের বড়ো দাবীকে উত্তেজিত করে দেওয়া মাত্র— থলির মুখ খুলল, এর পরে শেষ পর্য্যন্ত থলি ঝেড়ে দিতে হবে,— ওর শিলমোহরটা এবার টুট্ল। বিদেশী সাম্রাজ্যের এতটা দাক্ষিণ্য ইংরেজজাতের ছাড়া আর কোনো জাতের হাত দিয়ে হতে পারত না। হয়তো এই দানের সঙ্গে সঙ্গে সুবুদ্ধিও আছে। জগৎ জুড়ে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘূর্ণিবাতাস জেগে উঠচে তাতে ভারতবর্ষের মন না পেলে ভারতবর্ষকে শেষ পর্যন্ত আয়ত্ত করা সম্ভব হতে পারে না। যে মুসলমানকে আজ ওরা সকলরকমে প্রশ্রয় দিচ্চে সেই মুসলমানই একদিন মুষল ধরবে। যাই হোক্, লুব্ধতা স্বভাবে প্রবল থাকলে সুবুদ্ধির দূরদর্শিতা কাজ করতে পারে না। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস য়ুরাপের অন্য যে কোনো জাত এমন কি আমেরিকান কর্তা হলে ভারতবর্ষের গলার ফঁসে আরো লাগাত জোর— নিজেদের নির্ম্মম বাহুবলের পরেই সম্পূর্ণ ভরসা রাখত।— আমাদের তরফে একটা কথা বলবার আছে, ইংরেজের শাসনে যতই দাক্ষিণ্য থাক্ আজ পর্য্যন্ত না মিলল আমাদের উপযুক্ত শিক্ষা, না জুটল যথেষ্ট পরিমাণে পেটের ভাত, না ঘটল স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা। শাসনতন্ত্রের কাঠামো রক্ষা করতেই পুঁজি শেষ হয়ে আসে, প্রজাদের মানুষ করে তুলতে হাতে কিছুই থাকে না। এই ঔদাসীন্য আমাদের শতাব্দী ধরে হাড়ে মজ্জায় জীর্ণ করে দিল। আমাদের পাহারা আছে আহার নেই এমন অবস্থা আর কতদিন চল্বে। অথচ ওদের নিজের দেশে প্রজার অন্নাভাব সম্বন্ধে ওদের কত চিন্তা কত চেষ্টা। কেননা ওরা ভালো করেই জানে আধপেটা অবস্থায় কোনো জাতের মনুষ্যত্ব রক্ষা হয় না। আমাদের বেলায় সেই মনুষ্যত্বের মাপকাঠি ওরা ছোটো করে নিয়েছে তারি নির্ম্মমতা আমাদের সুদূর ভাবীকালকে পর্য্যন্ত অভিভূত করে রেখেছে। তাই মনে হয় নিজেদের স্বভাবগত সমাজগত প্রথাগত সকলপ্রকার দুর্ব্বলতা সত্ত্বেও নিজের দেশের ভার যে করেই হোক নিজেকেই নিতে হবে। পরের উপর নির্ভর করে থাকলে দুর্বলতা বেড়েই চলে, তা ছাড়া ইতিহাসের আবহমান দশাচক্রে অনন্তকাল ইংরেজের শাসন অচলপ্রতিষ্ঠ থাকতেই পারে না। নিজের ভাগ্য নানা ভুলচুক নানা দুঃখকষ্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়েই নিজে নিয়ন্ত্রিত করবার শিক্ষা আমাদের পাওয়া চাই।— সেই শিক্ষার আরম্ভপথ আমার অতি ক্ষুদ্র শক্তি অনুসারেই আমি নিয়েছিলুম। য়ুরোপের মতো আমাদের জনসমূহ নাগরিক নয়,— চিরদিনই চীনের মতোই ভারতবর্ষ পল্লীপ্রধান। নাগরিক চিত্তবৃত্তি নিয়ে ইংরেজ আমাদের সেই ঘনিষ্ঠ পল্লীজীবনের গ্রন্থি কেটে দিয়েছে। তাই আমাদের মৃত্যু আরম্ভ হয়েছে ঐ নীচের দিক দিয়ে। সেখানে কী অভাব কী দুঃখ কী অন্ধতা কী শোচনীয় নিঃসহায়তা, বলে শেষ করা যায় না। এইখানেই পুনর্ব্বার প্রাণসঞ্চার করবার সামান্য আয়োজন করেছি, না পেয়েছি দেশের লোকের কাছ থেকে উৎসাহ, না পেয়েছি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সহায়তা। তবু আঁকড়ে ধরে আছি। দেশকে কোন্ দিক থেকে রক্ষা করতে হবে আমার তরফ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর আমার এই গ্রামের কাজে। এতদিন পরে মহাত্মাজি হঠাৎ এই কাজে পা বাড়িয়েছেন। তিনি মহাকায় মানুষ, তাঁর পদক্ষেপ খুব সুদীর্ঘ। তবু মনে হয় অনেক সুযোগ পেরিয়ে গেছেন— অনেক আগে সুরু করা উচিত ছিল, এ কথা আমি বারবার বলেচি। আজ তিনি কন্গ্রেস ত্যাগ করেছেন। স্পষ্ট না বলুন এর অর্থ এই যে কন্গ্রেস জাতিসংঘটনের মূলে হাত দিতে অক্ষম। যেখানে কাজের সমবায়তা স্বল্প সেখানে নানা মেজাজের মানুষ মিল্লে অনতিবিলম্বে মাথা ঠোকাঠুকি করে মরে। তার লক্ষণ নিদারুণ হয়ে উঠেছে। এই সম্মিলিত আত্মকলহের ক্ষেত্রে কোনো স্থায়ী কাজ কেউ করতে পারে না। আমার অল্পশক্তিতে আমি বেশি কিছু করতে পারি নি কিন্তু এই কথা মনে রেখো পাবনা কন্ফারেন্স থেকে আমি বরাবর এই নীতিই প্রচার করে এসেচি। আর, শিক্ষাসংস্কার এবং পল্লীসঞ্জীবনই আমার জীবনের প্রধান কাজ। এর সংকল্পের মূল্য আছে, ফলের কথা আজ কে বিচার করবে।— খেলাচ্ছলে আমার তিনটে গানের ইংরেজি তর্জ্জমা করেছি তোমাকে এই সঙ্গে পাঠাই। ইতি ১৫ নবেম্বর ১৯৩৪
স্নেহানুরক্ত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন