দেখা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি
দেখা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি
"যখন যা দেখবে বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরে দেখবে। পিছন দিকে তাকাবে না"
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উক্তিটি ইংরেজিতে পড়ুন
উক্তিটির উত্স ও প্রসঙ্গ জানুন
রামকিঙ্কর তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ নিজের পোর্ট্রেট দেখে তাকে বলেছিলেন যখন যা দেখবে বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরে দেখবে। পিছন দিকে তাকাবে না।গণশক্তি অনলাইন :
১৯৭৫ সালে ঋত্বিক ঘটক শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ভাস্করকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র করলেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে জড়ানো গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘‘কিঙ্করদা, আপনি যখন রবীন্দ্রনাথের পোর্ট্রেট করছিলেন, তখন উনি আপনাকে কী বলেছিলেন শিল্প সম্পর্কে?’’রামকিঙ্কর স্মৃতির অতলে ডুব দেন, হাসতে থাকেন। যেন একটা অবয়ব রূপ পেতে চলেছে। তারপর বলেন, ‘‘উনি প্রথমে দেখে নিলেন কোথাও লোক আছে কিনা। কারণ অনেক সময় ওনার সঙ্গে লোক থাকত তো, সেক্রেটারিরা থাকতেন। সেই জন্য সব দেখে নিলেন। আমি ওধারে, পোর্ট্রেট করছি ওঁর। উনি বসে বসে লিখছিলেন আর কী, তারপরই বললেন, দেখো, যখন কিছু দেখবে, বাঘের মতো ঘাড় মুচড়ে ধরবে। পিছনে আর তাকাবে না। এই হল শেষ কথা।’’
একঢাল কোঁকড়ানো চুল, কালো চেহারার এক কিশোর বাঁকুড়ার যুগীপাড়ার দোলতলা বাজারে একটি গাছের নীচে বসে। তার পায়ের কাছে রাখা কাঠের বাক্সের উপরে ক্ষুর, কাঁচি, নরুন। অপেক্ষা খদ্দেরের। ক্ষৌরকর্মে সে পটু নয়, কিন্তু খদ্দের টানার জন্য কোনও হাঁকডাক নেই। বাক্সের উপরে রাখা একটি নরুন দিয়ে আনমনে গাছের গা কুঁদে নতুন শরীর তৈরি করছে নিজের কল্পনায়। আজন্ম অর্থাভাব কিশোরটির। আমৃত্যুও বলা চলে। বাবা চণ্ডীচরণ দিনভর যজমানদের বাড়ি খেউরি করেও সংসারের জোয়াল টানতে পারছিলেন না। আর কোনও পথ না পেয়ে স্ত্রী সম্পূর্ণাকে একদিন বললেন, ‘‘ছেলে এখন থেকেই উপার্জনে সাহায্য করুক।’’ সম্পূর্ণা স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, ‘‘ছেলেটা সবেমাত্র সুরেন পণ্ডিতের পাঠশালা থেকে চতুর্থটা পাশ দিয়ে বঙ্গ বিদ্যালয়ে ঢুকেছে। এখনই যদি ছাড়িয়ে দেওয়া হয়!’’ কিন্তু বাঁচতে তো হয় খেয়ে পরেই। বাবার ইচ্ছেয় ছেলে দোলতলা বাজারে এই গাছের নীচে ক্ষুর, কাঁচি নিয়ে বসে। আর গাছটার গায়েই তার মনের যাবতীয় ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলে।
বঙ্গ বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মা’র ইচ্ছেয় সন্ধ্যাবেলায় যেতে হচ্ছে যুগীপাড়া নৈশ বিদ্যালয়ে। যদিও লেখাপড়া বিষয়টাই তাকে তেমন একটা টানে না। তাই এই পরিবর্তন নিয়ে তার কোনও মাথাব্যথা নেই। বরং পড়তে বসে বেড়ার দেওয়ালে টাঙানো দেবদেবীর ছবিগুলোর দিকে চোখ চলে যায়, মন টানে। লেখার স্লেটে আঁকিবুঁকি চলে যেন তার অজান্তেই। বাড়ির বড়দের নজরে পড়লেই বকাবাদ্যিও জোটে দেদার। কিন্তু কি করবে সে, পড়ার থেকে তার ছবি আঁকাতেই আগ্রহ যে বেশি।
কুমোরপাড়ায় অনন্ত জ্যাঠার মূর্তি গড়া দেখতে তার বড্ড ভাল লাগে। সুযোগ পেলেই সে ছোটে সেখানে। পলক পড়ে না, একদৃষ্টে দেখতে দেখতে যেন ঘোর লাগে তার। সেই ঘোরে মূর্তিগুলো তার সঙ্গে কথা বলে! বলে, “কিঙ্কর এসো তোমার হাতের স্পর্শে আমাদের নতুন জন্ম হোক।” রোজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনন্ত জ্যাঠার কাজ দেখতে দেখতেই তার মূর্তি গড়ার সহজপাঠ। হাত ছোঁয়নি মাটির ছাঁচ। শুধু দেখে দেখেই সে এরমধ্যে শিখে নিয়েছে মূর্তি গড়ার বেশ কিছু কৌশল। কিছুদিন পরে বাড়িতে নিজের হাতে মাটির তাল দিয়ে ছোট-ছোট মূর্তি বানানো শুরু হয়ে যায় তার। নিজের মতো করে বানায় আর সাজিয়ে রাখে বেড়ার দেওয়ালের পাশে। কিন্তু পেটের দায় যে বড় দায়। তাই ইচ্ছে না করলেও তাকে এই গাছতলায় ক্ষুর-কাঁচি নিয়ে বসতে হয়েছে।
যদিও তাতে তার ভাবনাকে ফুটিয়ে তোলায় কোনও খামতি নেই। নিজেই রং বানায়, ছবি আঁকে। তার কল্পনারা ফুটে ওঠে কখনও মাটির তালে, কখনও কাগজে আবার কখনও গাছের গুঁড়িতে।
খেউরির কাজে ছেলের অনীহা দেখে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হন চণ্ডীচরণ। আবার দুটো বাড়তি আয়ের আশায় ছেলের বানানো মূর্তি নিয়েই মেলায় মেলায় নিজেই পসরা সাজান। বিক্রিও হয় ভালই। মনের ভাল লাগাকেই প্রাধান্য দিয়ে প্রতিকূলতাকে সামলে বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত যুগীপাড়ার সেদিনের সেই কৃষ্ণকায় কিশোরই তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হন ভবিষ্যতের প্রথিতযশা শিল্পী রামকিঙ্কর বেইজ হিসেবে।
স্রোতের বিপরীতে নিজের গতিতে চলা ভাস্করকে অনুভব করতেন কবি। তাই বোধহয় দু’জনের ভাবনায় এত মিল। কাছের মানুষদের চলে যাওয়া বারবার খুব কাছ থেকে দেখা দু’জনের মৃত্যুও ছিল একই রকম। শেষ যাত্রায় শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেতে চাননি কবি। যেতে চাননি কবির প্রিয় ভাস্করও। মৃত্যুর দু’দিন আগে কলকাতায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্রিয় ছাত্র সত্যজিৎ রায়কে বলেছিলেন, ‘‘মানিক, একটা রিকশা ডেকে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও!’’
বাঘের মতোই একবগ্গা তিনি সেই শৈশব থেকে। নিজেই বলতেন, ‘‘ধরেছি, আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছি। হজম করে ছিবড়ে করে ছেড়েছি। হজম করার মানে জানো? ও মন্ত্রটা আমার গুরুদেবের কাছে শেখা। তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে আমার অনেক ছবি, মূর্তি, অনেক কল্পনা, আর অনুভব।...’’
সিনেমার মতোই জীবন তাঁর। ফ্রেমের পর ফ্রেম দিয়ে ঋত্বিক যেন তাঁকে গড়তে চেয়েছিলেন তথ্যচিত্রটিতে। মাটির তাল থেকে পূর্ণাবয়ব রূপ পাওয়ার আগেই থেমে যেতে হয়েছিল পরিচালককে।
পর্দাতেও মুখোমুখি দুই শিল্পীর কথোপকথন। অসমাপ্ত। যেমন বাস্তবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন