সাম্যবাদ সম্পর্কে শিবরাম চক্রবর্তী-এর উক্তি
সাম্যবাদ সম্পর্কে শিবরাম চক্রবর্তী এর উক্তি :
“সাম্যবাদ 'আসলে এদেশেরই চারা— বিদেশের কলম্ নয়”
— শিবরাম চক্রবর্তী
উক্তিটির ইংরেজিতে পড়ুন
উক্তিটির উৎস ও প্রসঙ্গ জানুন:
লেখক শিবরাম চক্রধতীর অভিনব প্রবন্ধ-সংকলন ‘আজ এবং আগামী কাল’ প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। বর্তমান ‘মস্কো বনাম পণ্ডিচেরি’ শামাস্তরে সেই 'আজ এবং আগামীকাল’-গ্রস্থেরই পরিবর্ধিত সংস্করণ। সংকলনটি প্রকাশিত হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৫২ সালে।
এই প্রবন্ধ সংকলনের ভূমিকায় লেখক এই কথা লিখেছেন —
“... এই লেখাগুলি যখনকার, তখন কমিউনিজমের নামগন্ধও এদেশে ছিলনা। কিন্বা নাম-গন্ধই খালি ছিল; মার্কসীয় সাহিত্যেরও আমদানি হয়নি। এই নামমাত্র কমিউনিজম্ সম্বল করে, ঐ তন্ত্রে ওয়াকিবহাল না হয়েও যে আমি কলম ধরতে পেরেছিলাম, তার কারণ ‘সাম্যবাদ আসলে এদেশেরই চারা — বিদেশের কলম্ নয়। বিদেশী কমিউনিজমের বাস্তব চেহারা যাই কেন হোক্ না, তার আদর্শবাদী-যে রূপ তা ভারতীয় মনেরই অনুরূপ। সাম্যের মূল ভারতীয় ঐতিহ্যের অন্তর্গত, তার অন্তর-গতি আমাদের মনের ফল্গুধারায়। সমস্ত মানুষের সমত্ব আর মানুষের প্রতি মমত্ব — এই-বোধের দৃষ্টি এখানে এতই সহজ যে এর জন্য মার্কসীয় দর্শনের অপেক্ষা রাখে না। উপনিষদে উপ্ত, আর বুদ্ধদেবে অঙ্কুরিত হয়ে গান্ধীজীতে এসে তা শাখাপ্রশাখায় প্রসারিত হয়েছে। গান্ধীবাদই, আমার মনে হয়, কমিউনিজমকে সম্পূর্ণ করতে পারে। একদিন তা করবেও। ভারতীয় আত্মিক-সাম্যের সঙ্গে সমাজতন্ত্রের আর্থিক সাম্য-নীতির আত্মীয়তা ঘটলেই বিশ্বজনীন সাম্যবাদের সাফল্য ঘটতে পারে। আর, ঘটবেও তাই।আমার এই লেখাগুলির মূলকথাও ছিলো ঐ। এই বইয়ের প্রথম সংস্করণ ‘আজ এবং আগামী কাল’-এর গোড়ায় যা আমি বলেছিলাম সেহ সেই ভূমিকাটি এখানে হুবহু তুলে দেয়া হোলো :
“স্বাধীনতা আজ দুরে, তাই দূর থেকে তাকে আজ লক্ষ্যের (Goal) মতো দেখায় বটে, কিন্ত স্বাধীনতা লাভ করলে দেখতে পাবো, সেইখানেই আমাদের পথ ফুরোয়নি। তখন সমাজতান্ত্রিক বাষ্টব্যবস্থার প্রবর্তন করাই হবে লক্ষ্য। কিন্তু সাম্যবাদী সমাজতন্ত্রের পথ যেখানে শেষ হয়েচে, সেইখানেই আমাদের গতি-সমাপ্তি নয়, তার পরেও আমাদের এগিয়ে ষেভে হবে।
রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের প্রভেদ আছে। কিন্ত তার অর্থ এ নয যে রাশিয়া তার কর্মসাধনার ফলে সর্বমানবের যে-কল্যাণ আহরণ করচে তার থেকে আমাদের বঞ্চিত রাখতে হবে। রাশিষ প্রত্যেক মানুষের মুখে রুটি দেবার ব্যবস্থা করেচে; কিন্তু যেহেতু রুটি দে৪য়াটা অতি তুচ্ছ কাজ, তাব চেয়ে অমৃত দেওয়া ঢের বড়ো, সেইজন্য রাশিয়ার অর্থনীতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভারতের আভিজাত্যিক আত্মসম্মানে ঘা লাগবে, একথা মানতে পারিনে। প্রত্যেক মানুষকে যদি অমুতের সন্ধান দিতে পাবি সে তো ভালোই, কিন্ত আগে তাকে রটির সন্ধান দিয়ে তার পরে।
ভারতের বৈশিষ্ট্য আছে, ঐশর্য আছে, ---ভারতেরও মানুষকে দেবার নিজস্ব-কিছু আছে, একথও অস্বীকার করবো না। ভারতকে অমুতের সন্ধানই দিতে হবে। এবং এই জন্যই, জগতের সভ্যতায় রাশিয়ার কাজ যেখানে শেষ হয়েচে, একমাত্র সেখানেই ভাবতের কাজ শুরু হতে পাবে। রাশিয়া মানুষকে ভাণ্ড যোগালেই ভারত সেই ভাণ্ডে অমৃত-রস বিতরণ করতে পাবে। এই জন্যই সমাজতন্ত্রের পথকে এড়িয়ে গেলে আমাদেব চলবে না, সেপথ আমাদের পেরিয়ে যেতে হবে।”
অবশেষে একটি কথা। কথাটি বিশ্বভারতীকে নিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য করে 'কবি জয়ন্তী'তে একটি অপবাচক বাক্য ছিলে (এখনো আছে), লাইনটি এবারে আমি তুলে দিতে পারতাম কিন্তু ইচ্ছে করেই দিইনি। সেযুগের এক লেখকেব উদ্ধত রূপের উদাহরণ-স্বরূপ রেখে দিয়েছি । কিন্তু একথা আমি এখানে বলতে চাই যে, বিশ্বভারতীকে রবীন্দ্রনাথের অপকর্ম বলে এখন আমি মনে করিনে । মনে করি এটা তাঁর অপত্য-কর্ম। জাতির পিতৃজনোচিত তাঁর বিপুল সৃজনীশক্তির পরাকাষ্ঠা ঠিক এ না হলেও তাঁর বিরাট বাৎসল্যের একটা পরিচয় যে, তাঁর ভূল নেই। স্রষ্ঠার সব সৃষ্টিই, বা সবটাই কিছু নিখুঁত হয় না, তা নিয়ে খুঁৎ খুঁৎ করার কোনো মানে হয় না।...”
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন